ইঁদুর কামড়ালে করণীয় কী?
ইঁদুর একটি ছোট প্রাণী হলেও এরা আমাদের অনেক ক্ষতি করে থাকে। এরা বিভিন্ন আকৃতির
এবং বিভিন্ন প্রজাতির হয়। এদেরকে মূলত নিশাচর প্রাণী বলা হয় ,কারণ এরা
দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বেশি ঘোরাঘুরি করে। আমরা আজকের এই ব্লগে ইঁদুর
কামড়ালে কি কি ক্ষতি হতে পারে এবং তা থেকে প্রতিকারের উপায় কি এই
বিষয়ে জানতে পারবো।
সূচিপত্রঃ
- প্রাথমিক কথা
- ইঁদুরের বৈশিষ্ট্য
- ইঁদুরের খাদ্যাভ্যাস
- ইঁদুরের জীবনচক্র
- ইঁদুরের ক্ষতিকর দিক
- ইঁদুরের কামড়ে হতে পারে এমন রোগ সমূহ
- ইঁদুর কামড়ালে করণীয়
- ইঁদুর প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের উপায়
- উপসংহার
ইঁদুরের বৈশিষ্ট্যঃ
ইঁদুরকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
শ্রেণীবিন্যাস গত বৈশিষ্ট্য
দেহগত বৈশিষ্ট্য
ইঁদুরের শ্রেণীবিন্যাস গত বৈশিষ্ট্যঃ
রাজ্য (Kingdom): Animalia
পর্ব (Phylum): Chordata
শ্রেণী (Class): Mammalia
বর্গ (Order): Rodentia
গোত্র (Familly): Muridae
গণ (Genus) : Mus
প্রজাতি (Species) : Rattus rattus (কালো ইঁদুর), Rattus norvegicus (বাদামি
ইঁদুর)
ইঁদুরের দেহগত বৈশিষ্ট্যঃ
এদের দেহ ছোট ও লম্বাটে হয়। এদের শরীর লোমে পূর্ণ থাকে। এদের গড় দৈর্ঘ্য
৬ থেকে ৯ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এদের চোখ ছোট ও কালো হয় এবং রাতে দৃষ্টিশক্তি
প্রখর হয়। এদের কান বড় হওয়ায় শব্দ শুনতে তীক্ষ্ণ হয়। এদের ঘ্রাণ শক্তি প্র।
তাই খাবার ও বিপদ বুঝতে নাক ব্যবহার করে।
ইঁদুরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সামনের ধারালো দাঁত। ইঁদুরের এই দাঁত
সারাজীবন বাড়তেই থাকে, ফলে নিয়মিত বিভিন্ন জিনিস চিবিয়ে দাঁত ঘষে ছোট রাখে। এ
কারণে কাপড়, কাগজ, কাঠ, প্লাস্টিক ইত্যাদি কাটতে থাকে।
এরা খুবই চটপটে এবং দ্রুতগতির হয়ে থাকে। এরা দেয়ালে উঠতে পারে, লাফ দিতে পারে
এবং গর্ত করতে পারে। এরা সাধারণত নিশাচর হয়ে থাকে, তবে এদের দিনের বেলায় দেখা
যায়। এরা মূলত দলে দলে থাকতে পছন্দ করে।
ইঁদুরের খাদ্যাভ্যাসঃ
ইদুর মূলত সর্বভুক প্রাণী, অর্থাৎ এরা উদ্ভিদ জাত এবং প্রাণিজ যাত উভয় ধরনের
খাবারই খেতে পারে। এরা প্রধানত শস্য খেয়ে বেঁচে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় ফলমূল
এবং শাকসবজিও দেখা যায়। এরা বিভিন্ন ধরনের বাদাম এবং বীজও খেয়ে থাকে। এছাড়াও
রান্না করা খাবার এদের খুব প্রিয়।
এরা কাগজ কাপড় , ব্যাগ , প্লাস্টিক ইত্যাদি কেটে ফেলে। যদিও এগুলো খাবার নয় তবুও
এরা দাঁত ঘষার জন্য চিবিয়ে থাকে। এরা মাঝে মাঝে ছোট পোকামাকড় বা মৃত প্রাণীর
মাংস খেয়ে থাকে।
ইঁদুরের জীবন চক্রঃ
ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে আগে ইঁদুরের জীবনচক্র সম্বন্ধে ধারণা থাকা উচিত। ইঁদুরের
জীবন চক্র তুলনামূলক ভাবে ছোট। কিন্তু এরা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ
করে। ইঁদুরের জীবন চক্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যেমনঃ
প্রসবকাল
শিশুকাল
যুবক অবস্থা
আয়ুষ্কাল
প্রসবকালঃ
একটি স্ত্রী ইঁদুর গড়ে ২১ থেকে ২৪ দিনে বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এরা
একেবারে ছয় থেকে বারটি পর্যন্ত বাচ্চা জন্ম দিতে পারে।
শিশুকালঃ
জন্মের সময় বাচ্চা ইঁদুরের চোখ বন্ধ থাকে এবং শরীরের লোম থাকে না। প্রায় দুই
সপ্তাহের মধ্যে চোখ খুলে যায়। এরপর শরীরের লোম ও গজাতে শুরু করে।
যুবক অবস্থাঃ
একটি ইঁদুর জন্মের প্রায় চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই প্রজনন ক্ষমতা হয়ে
যায়। যার কারণে এদের সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি লাভ করে।
আয়ুষ্কালঃ
এরা প্রাকৃতিক পরিবেশে সাধারণত এক থেকে দেড় বছর বাঁচতে পারে। তবে নিরাপদ ল্যাব
পরিবেশে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
ইঁদুরের ক্ষতিকর দিকঃ
ইঁদুরের বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যার মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে , গৃহস্থালি
ক্ষেত্রে , স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রে , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি সাধন করে
থাকে।
কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষতিঃ
এরা জমিতে ধান , গম , ভুট্টা , আলু ইত্যাদি ফসল নষ্ট করে। এরা দাঁত দিয়ে
ফসল চিবিয়ে জমিতে কেটে ফেলে রেখে দেয়। ফলে ফলন কমে যায়। এরা গুদামজাত খাদ্য
খেয়ে নষ্ট করে থাকে।
গৃহস্থালি ক্ষতিঃ
এরা ঘরে রাখা চাল, ডাল , আটা, বিস্কুট, রুটি, ফল ইত্যাদি খেয়ে ফেলে। এছাড়াও কাপড় , বই, আসবাবপত্র , বৈদ্যুতিক তার কেটে দেয় এবং দেয়ালে ও মেঝেতে গর্ত করে , ফলে ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। মাটির দেওয়াল অথবা মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে মাটি তুলতে থাকে।
স্বাস্থ্য গত ক্ষতিঃ
ইঁদুর অনেক ভয়াবহ রোগ ছড়ায়। যেমনঃ
প্লেগ , লেপ্টো স্পাইরোসিস , সালমোনিলা , হান্টা ভাইরাস
, রেবিস প্রভৃতি। খাবার নষ্ট করার সময় ইঁদুরের প্রস্রাব , মল ও লোম খাবারের
সাথে মিশে গিয়ে রোগ সৃষ্টি করে।
অর্থনৈতিক ক্ষতিঃ
এরা ফসল ও খাদ্য নষ্ট করে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষতি নিয়ে আসে। বাড়ি ও অফিসে
বিদ্যুতের তার কেটে দেওয়ায় শর্ট সার্কিট ঘটিয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে।
ইঁদুরের কামড়ে হতে পারে এমন কিছু রোগঃ
র্যাট বাইট ফিভারঃ এটি ইঁদুরের কামড়ের সবচেয়ে সাধারণ একটি রোগ। এই রোগের জীবাণুর নাম Streptobasillus moniliformis অথবা Spirillum minus।
এই রোগের লক্ষণঃ জ্বর , মাথা ব্যথা , পেশি ব্যথা , জোড়ায়
ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। এই রোগের চিকিৎসা না করালে মারাত্মক
ক্ষতি হতে পারে।
টিটেনাসঃ ইঁদুরের কামড়ে ক্ষতস্থানে Clostridium tetani ব্যাকটেরিয়া ঢুকতে পারে ।
এই রোগের লক্ষণঃ পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া , খিচুনি, শ্বাসকষ্ট
ইত্যাদি। এই রোগ প্রতিরোধে টিটেনাস টিকা দেওয়া হয়।
জলাতঙ্কঃ যদিও ইঁদুরে জলাতঙ্ক খুব সাধারণ নয় , তবে অনেক সময় ভাইরাস
বহন করতে পারে।
এই রোগের লক্ষণঃ প্রচন্ড মাথা ব্যথা , ভয়ের অনুভূতি , পানি দেখলে আতঙ্ক , খিচুনি , শেষ পর্যন্ত মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধে দ্রুত রেবিস ভ্যাকসিন নিতে হবে ।
লেপটো স্পাইরসিসঃ ইঁদুরের প্রস্রাবের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ছড়ায় এবং কামড়ের মাধ্যমেও এই ভাইরাসটি শরীরের প্রবেশ করতে পারে।
এই রোগের লক্ষণঃ জ্বর , মাথাব্যথা , চোখ লাল হওয়া , লিভার ও কিডনিতে সমস্যা ইত্যাদি দেখা যায় ।
সাল্মনেলসিসঃ কামড়ের মাধ্যমে বা ক্ষতস্থানে আক্রমণ ঘটাতে পারে ।
এ রোগের লক্ষণঃ ডায়রিয়া , বমি , জ্বর , পেটে ব্যথা ইত্যাদি
।
হান্টা ভাইরাসঃ সাধারণত ইঁদুরের মলমূত্র থেকে ছড়ায়। তবে কামড়ের
মাধ্যমে সংক্রমণ সম্ভব।
এই রোগের লক্ষণঃ জ্বর , কাশি , শ্বাসকষ্ট , কিডনিতে সমস্যা
ইত্যাদি।
ঃ ঝুঁকিঃ রোগ গুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অনেক সময় প্রাণঘাতী হতে পারে । বাচ্চা , বৃদ্ধ ও দুর্বল মানুষকে এই ভাইরাসগুলো দ্রুত আক্রমণ করে থাকে । ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সম্ভাবনা থাকে ।
ইঁদুর কামড় দিলে করনীয়ঃ
ইঁদুরের কামড়কে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়। ইঁদুরের কামড়ে বিভিন্ন ধরনের
জীবাণু দেহে প্রবেশ করতে পারে। সে সব জীবাণুর কারণে দেহে মারাত্মক রোগ তৈরি
হতে পারে। তাই সাথে সাথে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। ইঁদুরে কামড়
দিলে অবিলম্বে ক্ষত পরিষ্কার , টীকা গ্রহণ , আর ডাক্তারের কাছে
যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
ইঁদুরে কামড় দিলে শুরুতেই রক্ত বের হতে দিতে হবে , এতে জীবাণু কিছুটা বের
হয়ে যায় । এরপরে সাবান ও পরিষ্কার পানিতে অন্তত ১৫ মিনিট ক্ষত
ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে । এরপরে ক্ষতস্থানে পরিমাণ মতো আয়োডিন ,
স্পিরিট বা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহার করতে হবে ।
এরপরে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে । এটি সবচেয়ে
জরুরি । টিটেনাসের টিকা নিতে হবে , যদি সাম্প্রতিক সময়ে না নেওয়া
থাকে । অনেক ক্ষেত্রে রেবিস ভ্যাকসিনও নিতে হয় , কারণ ইঁদুর
জলাতঙ্ক ভাইরাস ও বহন করতে পারে । এরপরে ডাক্তার প্রয়োজন হলে
অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেবেন যাতে সংক্রমণ না হয়
ইঁদুর প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। খাবার খোলা অবস্থায় না রেখে
ঢাকনা দেওয়া পাত্রে সংরক্ষণ করা। গুদামঘর , রান্নাঘর , ও ঘরের
কোন নিয়মিত পরিষ্কার করা । খাবারের টুকরো , আবর্জনা ও নোংরা দ্রুত
ফেলে দেওয়া । বাসার আশেপাশে পরিষ্কার রাখা ।
দেয়াল , দরজা , জানালা বা মেঝেতে ফাঁক ফোঁকর থাকলে সিমেন্ট বা লোহার জালি দিয়ে বন্ধ করা । পানি ও গ্যাস লাইনের চারপাশের ফাঁকা মেরামত করা । দরজা জানালায় জালি ব্যবহার করা । খাবার গুদামজাত করলে সব তো ঢাকনাযুক্ত পাত্র ব্যবহার করা । পানির উৎস যেন সহজে না পাই , তা নিশ্চিত করা ।
ইঁদুর ধরার ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে । আঠালো বোর্ড বা খাঁচায়
ধরা ফাঁদ ব্যবহার কার্যকর হয় । এছাড়াও বাজারে পাওয়া যায় এমন ইদুর নাশক
ট্যাবলেট বা বিষ ব্যবহার করা যায় । তবে শিশু বা গৃহপালিত প্রাণীর
নাগালের বাইরে রাখতে হবে ।
বিড়াল পালন করলে ইঁদুরের সংখ্যা অনেকটা কমানো যায় , যেহেতু বিড়াল ইঁদুর
ধরে । কোন জায়গায় পেঁচা বা সাপ ও প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে
।
উপসংহারঃ
ইঁদুর ছোট প্রাণী হলেও এর ক্ষতিকর দিক বিশাল । একদিকে ফসল , খাদ্যসহ সম্পদ নষ্ট করে অর্থনীতিতে ক্ষতি আনে , অন্যদিকে কামড় ও সংক্রমনের মাধ্যমে প্লেগ , লেপটো স্পাইরসিস , টিটেনাস বা জলাতঙ্কের মতো ভয়াবহ রোগ ছড়ায় ।
তাই ইঁদুরকে অবহেলা না করে সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন । এর মাধ্যমেই ইঁদুরের ক্ষতি থেকে মানুষ , সমাজ ও অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url